আক্ষেপ
-অঞ্জনা গোড়িয়া
পুরীর জগন্নাথ ধাম দর্শন। নামটা সবার চেনা। প্রথম গিয়েছি বাবা মায়ের সাথে। তখন বয়স দশ। তবু বেশ মনে আছে সেই দিনগুলি। ক্লাব থেকে পুরী যাওয়ার গাড়ি ঠিক হয়েছিল। আমরা ভাই বোন মিলে পাঁচজন। এই প্রথম এত দূর এসেছি বাবার সাথে পুরীর পথে।
গাড়িতে বেশ হুল্লোড় করতে করতে পৌঁছে গেলাম পুরী ধাম।
ওখান থেকে জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি আরও অন্য অন্য স্থানে যেতে নিজেদেরই গাড়ি ঠিক করতে হয়।
এক একটা গাড়িতে আট জন করে।
আমারই পাড়ার কিছু দাদা এই গাড়িতে উঠে বসলো। বয়স্ক এক মানুষ গাড়ির ড্রাইভার। দেখে মনে হলো খুব অসুস্থ। খুব বেশি জোরে চালাতে পারছিল না।
আমাদের অন্য গাড়িগুলো অনেক আগেই পোঁছে যাচ্ছে। তাই দেখে এক দাদা বললো, একটু জোরে চালাও ভাই। দেখতে পারছো না সব গাড়ি চলে গেল।
গাড়িওয়ালা কোনো সাড়া করলো না। আরও একজন দাদা চেঁচিয়ে বললো, কি হলো ভাই। এত দেরি হলে যাবো কখন?
তারই মাঝে খারাপ হয়ে গেল গাড়িটা। সবাই রেগে আগুন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। বয়স্ক মানুষ একাই গাড়িটা ঠিক করে আবার রওনা দিল মন্দিরের দিকে। কিন্তু আরও যে স্লো হয়ে যাচ্ছে। ওড়িয়া ভাষায় একটা কথা কদিন বেশ শুনতে পাচ্ছিলাম। “ধাই কিরি কিরি” কথাটার মানে পরে জেনেছি “তাড়াতাড়ি চলো”।
তারপর মজা করে গাড়ির ড্রাইভারকে ওদের ভাষাতেই বললো “ধাই কিরি কিরি”।
তবু কোনো পরিবর্তন নেই। আরও অনেক জায়গায় যেতে হবে। এত দেরি হলে সব কিছু দর্শন করা যাবে না।
সেই রাগে গাড়ির অন্য এক দাদা, বাংলা ভাষায় যা খুশি উত্তম-মধ্যম গালাগালি দিল। আমি তখন ছোটো হলেও ভীষণ লজ্জা করছিল। একজন বাবার বয়সী মানুষকে কেউ কি পারে এমন বাংলা ভাষায় গালি দিতে?
আমার মাতৃভাষা বাংলা। আর সেই ভাষাতেই এসব খারাপ খারাপ কথা শুনতে খুব রাগ হচ্ছিল।
বারবার মা’কে বললাম, দেখতে পারছো না, ড্রাইভারের শরীর খারাপ। তাই চালাতে কষ্ট হচ্ছে। যেমন যাচ্ছে যাক না। একটু না হয় দেরি হবে। তাই বলে এসব কেন বলছে?
মা’ও ওদের একবার বারণ করলো, এসব বলো না। ছেড়ে দাও। এই তো এসে গেছি। কিছুক্ষণ পরে গাড়িটা থেমে গেল একটা গাড্ডায়।
গাড়িতে সেই দাদা মুখে যা আসছে তাই বলতে লাগলো। উল্টো পালটা কথা।
কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার দাদু প্রধান মন্দিরের গেটের কাছে গাড়ি থামিয়ে দিল।
মুখের ঘামটা মুছে নিজেই অন্য গাড়ি ঠিক করে দিয়ে বললো, এ গাড়ি আর যাবে না বাবু, আপনারা ওই গাড়িতে যান। আর সহজ বাংলা ভাষায় বললো, আমার ছেলে খুব অসুস্থ। অনেক টাকার দরকার। আমারও দু’দিন ধরে খুব জ্বর তবু নিজের শরীর খারাপ নিয়েও এসেছি গাড়ি চালাতে। আমি গাড়ি চালাই। সব ভাষাই কিছু কিছু জানতে হয়।
বাবা জগন্নাথ ধাম দর্শন করতে এসে আপনাদের নিজেদের মনটা শুদ্ধ করো বাবু। বাবার ধামে আমার কারণে মুখ খারাপ করো না। পাপ লাগবে বাবু।
সবাই চুপ। নিজেদের ভাষাকে ভালোবাসতে শেখো বাবু। বাংলা ভাষা যে তোমাদের মায়ের মতো। সে ভাষায় গালাগালি দিয়ে নিজের মাকে অসম্মান করছ বাবু? এই পবিত্র পুরীধামে এসে।
এত সুন্দর ভালো বাংলা জানে, তা কারোর জানা ছিল না। গাড়ি ভাড়া বাবদ কিছু দিতে চাইলো বাবা। ড্রাইভার দাদু মাথা নেড়ে “না “জানিয়ে চলে গেল দূরে।
আমরা গুটিকতক সভ্য বাঙালি লজ্জায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।